আপনি কি কুরবানীর সাথে আকিকা দেওয়ার নিয়ম সম্পর্কে জানতে চান? আপনার উত্তরটি যদি হ্যাঁ হয় তাহলে সঠিক জায়গাতে এসেছেন । কারণ আজকের পোস্টে আমরা আলোচনা করব কুরআন ও হাদিসের আলোকে সম্পূর্ণ শরীয়াহ মোতাবেক কোরবানির সাথে আকিকা দেওয়ার নিয়ম এবং কোরবানি ও আকিকার সময়সূচী ইত্যাদি সম্পর্কে ।
প্রতি বছর ঈদুল আযহার দিনে আমরা গরু, ছাগল ,মহিষ এবং ভেড়া সহ অন্যান্য হালাল পশু কুরবানী দিয়ে থাকি । কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় কোরবানি ও আকিকা একই সাথে দিতে হয় । আপনার সন্তান যদি ঈদুল আযহার কয়েকদিন আগে জন্মগ্রহণ করে তাহলে আপনি কোরবানি দিবেন নাকি আকিকা দিবেন অথবা কুরবানী ও আকিকা একসাথে দেওয়া যাবে কিনা তা জানা দরকার ।
আরও পড়ুন ➝ কত টাকা থাকলে কুরবানী ওয়াজিব
যদি কোরবানি ও আকিকা একই সাথে দেওয়া যায় তাহলে তার কি নিয়ম রয়েছে, কিভাবে পশুর নির্বাচন করতে হবে, গোশত বন্টন, আকিকা ও কোরবানি পশুর জবাই দেওয়ার সময়সূচী সবকিছু জানা খুবই দরকার । এখন আমরা কোরবানি ও আকিকা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব ।
আপনি যদি এই বিষয়ে জানতে আগ্রহী হন তাহলে পোস্টটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ সহকারে পড়তে থাকুন । আমার দৃঢ় বিশ্বাস সম্পন্ন পোস্টটি পড়ার পর আপনার কোরবানি ও আকিকা সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা হয়ে যাবে । তো আর দেরি না করে চলুন শুরু করা যাক ।
কুরবানী কি?
কুরবানী শব্দটি আরবি ‘কুরব’ থেকে এসেছে যার অর্থ নিকটবর্তী হওয়া। ইসলামের পরিভাষায় কুরবানী হল ঈদ-উল আযহার দিন এবং এর পরের দুই দিন (১০, ১১, ১২ জিলহজ) পশু জবাই করে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার একটি প্রক্রিয়া। এটি হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও তার পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ) এর মহান ত্যাগের স্মরণে পালন করা হয়। মুসলমানদের জন্য কুরবানী পালন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং এটি আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও ত্যাগের প্রতীক।
আকিকা কি?
আকিকা হল নবজাতক শিশুর জন্ম উপলক্ষে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য একটি নির্দিষ্ট ধরনের পশু জবাই করা। এটি সাধারণত শিশুর জন্মের সপ্তম দিনে পালন করা হয়। যদিও অন্য দিনেও করা যেতে পারে। আকিকার মাধ্যমে পরিবার শিশুর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করে এবং শিশুর মঙ্গল কামনা করে। ইসলামে এটি একটি সুন্নতে মুয়াক্কাদা অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত হিসেবে বিবেচিত।
কুরবানীর সাথে আকিকা
কুরবানী ও আকিকা উভয়ই আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে করা হয়। কিন্তু অনেক সময় দুটি অনুষ্ঠান একসাথে পালন করার প্রয়োজন হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ যদি ঈদ-উল আযহার সময় কোন নবজাতকের জন্ম হয় অথবা পূর্ব নির্ধারিত আকিকার দিনটি ঈদ-উল আযহার দিনগুলোর মধ্যে পড়ে তখন দুটি অনুষ্ঠান একসাথে করার বিষয়ে আলোচনা হয় এবং অনেকেই এই বিষয়ে জানতে চান।
ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী কুরবানী ও আকিকা একসাথে দেওয়ার বিষয়ে বিভিন্ন মাযহাবের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। কিছু মাযহাবে একসাথে কুরবানী ও আকিকা দেওয়া যাবে বলে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আবার কিছু মাযহাবে এটি পৃথকভাবে পালন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে অধিকাংশ ইসলামিক স্কলারদের মতে দুটি ইবাদতের উদ্দেশ্য আলাদা হওয়ায় এগুলো আলাদাভাবে পালন করাই উত্তম।
কুরবানীর সাথে আকিকা দেওয়ার নিয়ম
ইসলাম ধর্মে কুরবানী ও আকিকা দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় কাজ হিসেবে বিবেচিত। কুরবানী মূলত ঈদ-উল আযহার সময় পালন করা হয়। এটি আল্লাহর প্রতি ত্যাগের প্রতীক। অন্যদিকে আকিকা একটি নবজাতক শিশুর জন্ম উপলক্ষে পালন করা হয়। যা মূলত শিশুর জন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে।
আরও পড়ুন ➝ কুরবানী নামাজ পড়ার সম্পূর্ণ নিয়ম
এই দুটি অনুষ্ঠান অনেক ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা ভাবে পালন করা হলেও কিছু ক্ষেত্রে এগুলো একত্রে পালন করারও নিয়ম রয়েছে। এই পোস্টে আমরা কুরবানীর সাথে আকিকা দেওয়ার নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো। যারা এই বিষয়ে জানতে আগ্রহী তারা অবশ্যই পোস্টটি সম্পূর্ণ মনোযোগ সহকারে পড়বেন।
কুরআন ও হাদিসের আলোকে নিয়ম
কুরআন ও হাদিসে কুরবানী ও আকিকার বিষয়ে নির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেছেন, “প্রত্যেক নবজাতক তার আকিকার জন্য বন্ধক থাকে। তার পক্ষ থেকে সপ্তম দিনে পশু জবাই করা হবে, তার মাথার চুল মুণ্ডন করা হবে এবং নাম রাখা হবে।” (তিরমিযি)। অন্যদিকে কুরবানী সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, “তোমরা কুরবানীর উটগুলোকে আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছি; এতে তোমাদের জন্য মঙ্গল রয়েছে।” (সূরা হজ্জ)।
ফিকহের বিভিন্ন মাযহাবের দৃষ্টিভঙ্গি
হানাফি মাযহাবঃ হানাফি মাযহাবে কুরবানী ও আকিকা পৃথকভাবে পালন করাই উত্তম। তারা মনে করেন দুটি ইবাদতের উদ্দেশ্য ও ফজিলত আলাদা হওয়ায় এগুলো পৃথক হওয়া উচিত।
শাফেয়ী মাযহাবঃ শাফেয়ী মাযহাবে কুরবানী ও আকিকা একসাথে দেওয়া যেতে পারে। তবে তারা বিশেষ শর্ত আরোপ করেছেন। যেমন উভয় ইবাদতের নিয়ত পরিষ্কার থাকা।
মালিকি ও হাম্বলি মাযহাবঃ এই দুটি মাযহাবেও কুরবানী ও আকিকা পৃথকভাবে পালনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তাদের মতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য দুটি ইবাদত পৃথক হওয়া উচিত।
কুরবানীর সাথে আকিকা দেওয়ার শরীয়ত সম্মত উপায়
কুরবানী ও আকিকা একসাথে করতে হলে শরীয়ত সম্মত নিয়মগুলো অবশ্যই পালন করতে হবে। এতে মূলত দুটি উদ্দেশ্যের নিয়ত একসাথে করতে হবে এবং উভয় ইবাদতের জন্য আলাদা আলাদা পশু ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে কুরবানীর জন্য নির্ধারিত পশুর মানদণ্ড ও সময়ের নিয়মগুলো মানতে হবে।
সাধারণ ভুল এবং সেগুলি এড়ানোর উপায়
কুরবানী ও আকিকা একসাথে করার সময় কিছু সাধারণ ভুল হতে পারে। যেমন দুটি উদ্দেশ্য একসাথে না রাখা, এক পশুতে দুটি নিয়ত করা ইত্যাদি। অর্থাৎ একটি পশু দিয়ে কুরবানী ও আকিকা ২ টি কাজ করা যাবে না। এসব ভুল এড়ানোর জন্য ইসলামী স্কলারদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করা উচিত এবং যে কোন সন্দেহ হলে আলেমদের সাথে পরামর্শ করা উচিত।
কুরবানী ও আকিকার পশু নির্বাচন
কুরবানী ও আকিকার জন্য নির্ধারিত পশুর ধরন ও মানদণ্ড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত গরু, ছাগল, ভেড়া, উট ইত্যাদি পশু কুরবানী ও আকিকার জন্য ব্যবহার করা হয়। পশুটি অবশ্যই স্বাস্থ্যবান এবং নির্দিষ্ট বয়সের হতে হবে। গরু ও উটের ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুই বছর এবং ছাগল ও ভেড়ার ক্ষেত্রে এক বছর পূর্ণ হওয়া উচিত।
কুরবানী ও আকিকার পশু অবশ্যই রোগমুক্ত এবং স্বাস্থ্যবান হতে হবে। শরীরের কোন অঙ্গহানি হওয়া চলবে না। এছাড়াও, পশুর চোখ, কান, দাঁত ইত্যাদি সুস্থ থাকতে হবে।
কুরবানী ও আকিকার সময়সূচি
কুরবানীর সময় নির্ধারিত থাকে ঈদ-উল আযহার দিন এবং এর পরের দুই দিন। মোট তিন দিন কুরবানীর জন্য নির্ধারিত থাকে এবং এই সময়ের মধ্যে যেকোন সময় কুরবানী করা যেতে পারে।
আকিকার নির্দিষ্ট সময় নবজাতকের জন্মের সপ্তম দিন। তবে সপ্তম দিন পালন করা না গেলে ১৪তম বা ২১তম দিনেও করা যেতে পারে। মূলত এটি পরিবারের সুবিধা ও পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্ধারণ করা যায়।
কুরবানী ও আকিকার পশু জবাই
কুরবানী ও আকিকার পশু জবাইয়ের নিয়মগুলো শরীয়ত অনুযায়ী পালন করতে হবে। পশুর গলা কাটার সময় ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে আল্লাহর নাম নিতে হবে। জবাইয়ের সময় পশুর সমস্ত রক্ত বের হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
জবাইয়ের পর পশুর গোশত তিন ভাগে ভাগ করতে হবে। এক ভাগ নিজের জন্য, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের জন্য, এবং এক ভাগ দরিদ্রদের জন্য। আকিকার ক্ষেত্রে পুরো গোশত দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করাই উত্তম।
কুরবানী ও আকিকার গোশত বণ্টন
কুরবানীর গোশত তিন ভাগে ভাগ করে বণ্টন করার নিয়ম রয়েছে। একটি অংশ নিজ পরিবারে, একটি অংশ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুর মধ্যে, এবং বাকি অংশ দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। আকিকার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ গোশত দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করাই উত্তম।
গোশত বণ্টনের সময় পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে সদয়ভাবে এবং ন্যায্যভাবে বণ্টন করতে হবে। দরিদ্রদের মাঝে গোশত বিতরণের সময় তাদের প্রয়োজন ও অবস্থার প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে।
উপসংহার
কুরবানী ও আকিকা ইসলামের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। যা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও আনুগত্য প্রকাশের জন্য পালন করা হয়। কুরবানী ও আকিকা একসাথে দেওয়ার ক্ষেত্রে শরীয়তের নিয়মগুলো মেনে চলা জরুরি। সঠিকভাবে কুরবানী ও আকিকা পালন করার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি এবং আমাদের ইবাদত আরও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। আল্লাহ আমাদের সকলের ইবাদত গ্রহণ করুন এবং আমাদের জীবনে বরকত দান করুন। আমিন।